
দেশে মসজিদ, দর্গার নীচে মন্দির থাকা নিয়ে ধর্মীয় চর্চা এখন তুঙ্গে। তার উপর আবার পার্শবর্তী দেশ বাংলাদেশে হিন্দু সন্যাসীর গ্রেফতার নিয়ে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনার প্রেক্ষিতে সামাজিক মাধ্যম ফেসবুকে একটি ভিডিও পোস্ট শেয়ার করে দাবি করা হচ্ছে যে, অন্য ধর্মাবলম্বী মানুষের ভিড় হিন্দু মন্দির ভেঙ্গে ফেলছে। ভিডিওতে জনগণের একটি বিশাল ভিড়ের কোলাহলের মাঝে কয়েকজন মিলে একটি প্রতিমাকে ভেঙ্গে ফেলছে। ভিডিওটি শেয়ার করে ফেসবুক ব্যবহারকারী ক্যাপশনে লিখেছেন,”বারবার কেন হিন্দু ধর্মের উপর আঘাত আসবে হিন্দুরা কি এখনও চুপ করে বসে থাকবেন।“
অন্য এক ফেসবুক ব্যবহারকারী লিখেছেন,”দেখুন গতকাল বাংলাদেশে কিভাবে কালী মন্দিরে হা*ম”লা চালিয়ে মা কালীর মূর্তি সহ অন্যান্য দেবদেবীর মূর্তি ধ্বংস করে… এভাবে একের পর এক হিন্দু মন্দির ও প্রতিমা ভেঙ্গে ফেলছে চুসলমান জি*হা*দিরা… উল্টোদিকে আমরা ভারতীয় হিন্দুরা বসে বসে মজা দেখছি আর ঘুমাচ্ছি কারণ ওগুলো তো বাংলাদেশের হচ্ছে… (পুরো ভিডিও টার লিংক কমেন্ট বক্সে দিলাম)।“
তথ্য যাচাইয়ের মাধ্যমে আমরা পেয়েছি প্রতিমা ভাঙ্গার এই ঘটনায় কোন সাম্প্রদায়িক কোণ নেই। ভিডিওটি বাংলাদেশের নয় বরং ভারতেরই।
ফেসবুক পোস্ট, ফেসবুক পোস্ট, আর্কাইভ
তথ্য যাচাইঃ
এই দাবির সত্যতা যাচাই করতে আমরা ভিডিওর কি ফ্রেম নিয়ে গুগল রিভার্স ইমেজ সার্চ করি। ফলে, হুবহু এই একই ভিডিও বেশ কিছু ফেসবুক প্রোফাইলে পাওয়া যায় যার ক্যাপশনের মাধ্যমে প্রতিমা ভাঙ্গার এই ঘটনাটি এই প্রাচীন রীতি বলে জানিয়েছেন। এক ফেসবুক ইউজার এই ভিডিওটি শেয়ার করে লিখেছেন,” খণ্ডঘোষ ব্লকের বেরুগ্রাম গ্রাম পঞ্চায়েতের অন্তর্গত সুলতানপুর গ্রামের শতাধিক বছরের পুরোনো কালীপূজায় প্রাচীন রীতি অনুযায়ী, ১২ বছর পর পর কুল পুরোহিতেরা ১৩ ফুট দীর্ঘ কালী মূর্তির প্রথমে কড়ি আঙ্গুল ভাঙেন এবং তারপর মূর্তির বাকি অংশ গ্রামের সর্বস্তরের মানুষেরা ভেঙ্গে ভাঙ্গা অংশগুলিকে একে একে বিসর্জন দেন। বিসর্জন হওয়ার পর নতুন মূর্তি পুনরায় গড়ে পরবর্তী ১১ বছর ওই মূর্তিই পুজো হয়। এটাই বহু প্রাচীন ঐতিহ্য যেখানে ধর্ম-বর্ণ-নির্বিশেষে সকল সম্প্রদায়ের মানুষ অংশগ্রহণ করে থাকেন। এই পুজোকে কেন্দ্র করে প্রতি বছর কার্তিক মাসের অমাবস্যায় বহু মানুষের সমাগম হয় এই গ্রামে। তাঁরা তাঁদের বিশ্বাস ও ভক্তি ভরে আরাধনা করেন। দুর্ভাগ্যজনক ভাবে যারা ধর্ম নিয়ে রাজনীতি করে, তারা মানুষের রীতি- ধর্মীয় বিশ্বাসকে ব্যবহার করে মানুষে মানুষে সৌভ্রাতৃত্বের সম্পর্ককে কলুষিত করতে মূর্তি ভাঙ্গার প্রাচীন রীতির ভিডিওকে সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ লাগানোর অপকর্মে ব্যবহার করছে সমসাময়িক সময়ে দেশ ও পার্শ্ববর্তী দেশের রাজনৈতিক চাপানউতোর পরিস্থিতি ও ধর্মীয় ভাবাবেগকে কাজে লাগিয়ে। খণ্ডঘোষ ব্লকের সমস্ত গ্রামবাসীদের পক্ষ থেকে আমরা এই নোংরা মানসিকতাকে ধিক্কার জানাচ্ছি ও আমাদের সম্প্রীতির ঐতিহ্যকে অটুট রাখার আহ্বান জানাচ্ছি । নিচের ভিডিওটি এবারের পূজোর প্রাচীন রীতির ভিডিও; যেখানে গ্রামের সর্বস্তরের মানুষ অংশগ্রহণ করেছেন।“
প্রতিমা ভাঙ্গার এই ঘটনার অন্য কোণ থেকে ক্যামেরাবন্দি করা একটি ভিডিও পাওয়া যায় যেখানে তিনি ক্যাপশনে লিখেছেন,”আমাদের সুলতান পুর গ্রামের মা কালী প্রতি মায়ের নিরঞ্জন সময় 🙏🙏 জয় মা🙏🌺🙏🙏।“
তারপর ‘সুলতানপুর কিরনময়ী পাঠাগার’-এর ফেসবুক পেজেও একটি পোস্ট পাওয়া যায় যার একটি ভিডিওর সাথে দাবীকৃত পোস্টের ভিডিওর সাদৃশ্য রয়েছে। এই ফেসবুক পোস্টের ক্যাপশনে লেখা হয়েছে,”১২ বছরের ঐতিহ্যের কালীমাতা নিরঞ্জন মায়ের প্রতিমা নিরঞ্জন এর কিছু মুহূর্ত থেকে যাক 🙏 মা সবাই কে সুস্থ রেখো মা 🙏 স্থান: সুলতানপুর, খণ্ডঘোষ, পূর্ব বর্ধমান ১২ বছরের অপেক্ষার সমাপ্তি – মা কালীকে বিদায় জানাতে একসাথে!” আয়োজনে: সুলতানপুর কিরণময়ী পাঠাগার এবং সুলতানপুর গ্রামবাসীবৃন্দ।“
এই তথ্য মাথায় রেখে গুগলে প্রাসঙ্গিক কি ওয়ার্ড সার্চের মাধ্যমে ‘দৈনিক স্টেটসম্যান’-এর একটি প্রতিবেদন পাওয়া যায়। ২১ অক্টোবরের এই প্রতিবেদন অনুযায়ী, সুলতানপুরের খণ্ডঘোষ ব্লকে ১২ বছর পর দীপাবলিতে মা কালীর মূর্তির বিসর্জন হবে। ৬০০ বছরের পুরনো এই পূজায় কালী মূর্তির পাশাপাশি দুর্গা মাতা ও তাঁর চার সন্তানের মূর্তিও আছে। ১২ ফুট কালো মূর্তি নিয়মিত পূজিত হয়। বিসর্জনের পর নতুন প্রতিমা তৈরি হবে এবং ১২ বছর পর আবার নিরঞ্জন হবে।
তারপর ফ্যাক্ট ক্রিসেণ্ডো খণ্ডঘোষ পুলিশ থানার সাথে যোগাযোগ করি। সেখান থেকে আমাদের জানান,” ভিডিওটি পশ্চিমবঙ্গের সুলতানপুরের এবং এতে কোনো ধরনের সাম্প্রদায়িক কোণ নেই। এই গ্রামে বছরের পর বছর ধরে চলে আসছে কালী মন্দিরের ঐতিহ্য। প্রতি ১২ বছর পর পর এখানে কালী মন্দিরে কালী মাতার মূর্তি বিসর্জন করা হয়। দীপাবলি পূজা শেষ হওয়ার পর, মন্দিরের পণ্ডিতরা কালী মাতার মূর্তির একটি অংশ ভেঙ্গে পাশের পুকুরে বিসর্জন করেন, এরপর প্রতিমার ভাঙা অংশগুলি সারাদিন পুকুরে ডুবিয়ে রাখা হয়। এই পুরো ঘটনার সঙ্গে সাম্প্রদায়িকতা ও সহিংসতার কোনো যোগসূত্র নেই।“
নিষ্কর্ষঃ তথ্য যাচাইয়ের মাধ্যমে ফ্যাক্ট ক্রিসেণ্ডো এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছে যে, ভাইরাল হওয়া ভিডিওটি অন্য ধর্মাবলম্বী মানুষ কর্তৃক কালী মন্দিরের মূর্তি ভাঙার ঘটনা নয়। এটি পূর্ব বর্ধমানের সুলতানপুরে অবস্থিত কালী মন্দিরের ঘটনা যেখানে ১২ বছর পর ঐতিহাসিক প্রথা অনুযায়ী কালী মায়ের মূর্তি বিসর্জন করা হয়। এই ঘটনার সঙ্গে সাম্প্রদায়িকতার কোনো সম্পর্ক নেই।

Title:বাংলাদেশে দেবী কালীর মূর্তির ভাঙচুর করা হচ্ছে? জানুন ভিডিওর সত্যতা
Fact Check By: Nasim AkhtarResult: False