
মঙ্গলে এক একর জমি মাত্র ৩ হাজার টাকায়, কিনবেন? শিরোনামটি দেখলেই চোখে লাগে। মঙ্গলে জমি, তাও কী সম্ভব? সম্ভব অসম্ভবের ব্যাপারে পরে আসছি। কিন্তু একটি বিষয় না বললেই নয়, মিডিয়ার প্রতিযোগীতায় ক্লিক পাওয়ার জন্য বাংলার নাম করা বড় বড় সংবাদমাধ্যমগুলি কতটা শিশুসুলভ রিপোর্টিং করতে পারে তার উপযুক্ত উদাহরণ হল মঙ্গলে জমি কেনার এই গল্পটি।
এই বিশেষ প্রতিবেদনের দাবি হল, মঙ্গলে জমি কিনেছেন পশ্চিমবঙ্গের হুগলী জেলার শ্রীরামপুরের বাসিন্দা শৌনক দাস। একেবারে জলের দামে কিনেছেন এক একর জমি। এক বিঘা নয়, দুই বিঘা নয়, মাত্র তিন হাজার টাকায় মঙ্গলের মাটিতে এক একর জমি কিনেছেন তিনি।

এবিপি আনন্দ ছাড়াও এই দলে যোগ দিয়েছে নিউজ ১৮ বাংলা এবং জি ২৪ ঘণ্টা। তাছাড়া, অন্যান্য ছোট থেকে বড় নিউজ পোর্টাল তো রয়েইছে।


এই খবরটিকে বাংলা ছাড়াও কয়েকটি ইংরেজি সংবাদমাধ্যমও প্রকাশ করেছে কিন্তু প্রতি ক্ষেত্রে তারা পাঠকদের বার বার মনে করিয়ে দিয়েছে ‘জমি কেনার দাবি করেছেন শ্রীরামপুরের এই বাসিন্দা’। এবং শেষে সাফাইও দিয়ে বলেছেন, সত্যি না মিথ্যে আমরা জানিনা কিন্তু এটাই এখন সোশ্যাল মিডিয়ার হট টপিক। অন্যদিকে, বাংলা সংবাদমাধ্যমগুলি সোজাসুজি ঘোষণা করে দিয়েছে যে জমি কিনেছেন এই ব্যক্তি। কোনও প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নাসা অনুমোদিত সংস্থার কাছে কিনেছেন এই জমি আবার কোথাও বলা হয়েছে নাসা একটি সংস্থাকে দিয়ে এই জমি পাওয়ার ব্যবস্থা করে দিয়েছে শৌনককে।
তথ্য যাচাই
প্রথমেই আমরা শ্রীরামপুরের বাসিন্দা শৌনক দাসের সাথে যোগাযোগ করি। তিনি বলেন, বাইমার্স ডট কম নামের একটি আমেরিকান ওয়েবসাইট থেকে তিনি এই জমি কিনেছেন। এই ওয়েবসাইটের কাছেই নাকি রয়েছে মঙ্গলের জমির কপিরাইট। তাকে মঙ্গলের জমির দলিল। প্লট নাম্বার, লঙ্গটিটুইড, ল্যাটিটুউড এবং জমির সঠিক অবস্থানও পাঠিয়ে দিয়েছেন। নাসার সাথে যোগাযোগের বিষয়ে তিনি নিজেই বলেন, এই সংস্থার সাথে নাসার সরাসরি কোনও যোগ নেই।
শৌনক বাবু তার দলিলের ছবি আমাদের পাঠান।

প্রথমে আমরা বাইমার্স ওয়েবসাইটে যাই। অ্যাবাউট আস সেকশন থেকে জানতে পারি, এই ওয়েবসাইটটি মঙ্গলের জমির ডাইরেক্ট মার্কেটিং করার জন্য তৈরি করা হয়েছিল। ‘ইন্টারন্যাশনাল অ্যাসোসিয়েশন অফ হিউম্যান প্ল্যানেটারি এক্সপ্লোরেশন (IAOHPE)’ নামে একটি সংস্থার অনুমোদিত এজেন্ট এই ওয়েবসাইটটি। এবং যারা এই ওয়েবসাইট থেকে জমি ক্রয় করেন তাদের নাম এই সংস্থায় রেজিস্টার করা থাকবে। এই একই কথা শৌনকবাবুর পাওয়া দলিলেও লেখা রয়েছে।

গুগলে কিওয়ার্ড ও বিভিন্ন রকম সার্চ করে জানতে পারি, ‘ইন্টারন্যাশনাল অ্যাসোসিয়েশন অফ হিউম্যান প্ল্যানেটারি এক্সপ্লোরেশন (IAOHPE)’ নামে কোনও সংস্থার অস্থিত্বই নেই। মজাদার ব্যাপার হল, বাইমার্স ছাড়া আরও দুটি ওয়েবসাইটে থেকে দাবি করা হচ্ছে তারা ‘ইন্টারন্যাশনাল অ্যাসোসিয়েশন অফ হিউম্যান প্ল্যানেটারি এক্সপ্লোরেশন (IAOHPE)’ এর অনুমোদিত এজেন্ট এবং তারাও চাঁদ, মঙ্গলের জমি বিক্রি করেন।
প্রথমটি হল লুনারল্যান্ড ডট কম। এই ওয়েবসাইট খুলে দেখতে পাই, এটি বাইমার্স ডট কম ওয়েবসাইটের কার্বন কপি। হুবহু এক দেখতে। অ্যাবাউট আস সেকশনটি অক্ষরে অক্ষরে মিলে যায়। শুধু এরা মঙ্গলের জমি ছাড়া চাঁদের জমিও বিক্রি করেন। ব্যাস এতটুকুই পার্থক্য।

দ্বিতীয় ওয়েবসাইটির নাম হল অফিসিয়াল লুনারল্যান্ড ডট কম। একইরকম দেখতে আরেকটি মঙ্গলের জমি বিক্রি করার ওয়েবসাইট। এদেরও দাবি, এরা ‘ইন্টারন্যাশনাল অ্যাসোসিয়েশন অফ হিউম্যান প্ল্যানেটারি এক্সপ্লোরেশন (IAOHPE)’ এর অনুমোদিত এজেন্ট।

তাহলে এই পর্যন্ত সবমিলিয়ে যা দাঁড়াল তা হল, তিনটি ওয়েবসাইট চাঁদ ও মঙ্গলের জমি বিক্রি করে। এবং এরা ‘ইন্টারন্যাশনাল অ্যাসোসিয়েশন অফ হিউম্যান প্ল্যানেটারি এক্সপ্লোরেশন (IAOHPE)’ নামে এক আন্তর্জাতিক সংস্থার এজেন্ট। কিন্তু, মজার ব্যাপার এই নামে কোনও সংস্থার অস্তিত্বই নেই। এই তিনটি ওয়েব সাইট হল –
শৌনক বাবুর দেওয়া দলিলে ছবির নিচে আমরা দেখতে পাই, লুনারল্যান্ড ডট কম লেখা সিল রয়েছে। অর্থাৎ, এই তিনটি ভুয়ো ওয়েবসাইট চালাচ্ছে লুনারল্যান্ড নামে এক সংস্থা। এই ওয়েবসাইটগুলি কোনও রেজিস্ট্রেশন নাম্বার নেই। তিনটি সাইটই দাবি করে এনবিসি, বিবিসি, টাইমস, ফক্স নিউজ সহ ৭৫০টি খবরের কাগজ ও ম্যাগাজিন এই ওয়েবসাইট গুলি নিয়ে খবর প্রকাশ করেছে। আমরা একটিও খুঁজে পাইনি। নাসার সাথে এই এজেন্সি গুলির অনুমোদনের কথা ওয়েবসাইটে কোথাও বলা নেই। এই ওয়েবসাইটগুলিতে যোগাযোগের জন্য কোনও অফিসিয়াল মেল আইডি বা ফোন নাম্বার দেওয়া নেই। তিনটি সাইটে দেওয়া ফেসবুকের লিঙ্কে ক্লিক করলে দেখা যায় ‘লুনারল্যান্ড’ নামে একটি পেজকে সব যায়গায় ব্যবহার করা হয়েছে।
বাইমার্স ডট কম দাবি করেছে,
“ইউএন আউটার স্পেশ অ্যাক্ট ট্রিটি অফ ১৯৬৭ অনুযায়ী, কোনও সরকার পৃথিবীর বাইরে মহাকাশের কোনও জমি দখল করতে পারবে না। কিন্তু এই ট্রিটি ইন্ডিভিজুয়াল (স্বতন্ত্র) গ্রাহক এবং কর্পোরেশনদের মেনশন করেননি।“
ইউএন এর ওয়েবসাইটে অফিস অফ আউটার স্পেস বিভাগে আমরা এই ট্রিটির উল্লেখ পাই। এই টিটির শর্ত অনুযায়ী,
“আউটার স্পেস সার্বভৌমত্বের দাবিতে, ব্যবহার বা পেশার মাধ্যমে বা অন্য কোনও উপায়ে জাতীয় বরাদ্দের বিষয় নয়। চাঁদ এবং মহাকাশের অন্যান্য স্থানগুলি কেবলমাত্র শান্তিপূর্ণ উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা হবে।“
অর্থাৎ, কোনও দেশ, ওই দেশের সরকারি বা বেসরকারি সংস্থা এবং কোনও বাসিন্দা তার ব্যবহারের জন্য চাঁদ বা মহাকাশের অন্যান্য গ্রহের জমি ব্যবহার করতে পারবে না। মানবজাতির কল্যান ও সম্পূর্ণ বিশ্বের লাভ হবে এমন কাজেই একমাত্র আউটার স্পেসকে ব্যবহার করা যাবে। এই জমি অধিগ্রহণের জন্য নয়।

স্পেস ট্রিটির শর্তের কথা উল্লেখ করে এবিপি তাদের প্রতিবেদনে বলেছেন,
“পরবর্তীতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কমার্শিয়াল স্পেস লঞ্চ কমপিটিটিভ অ্যাক্ট আনে, যেখানে আরও নির্দিষ্ট করে বলা হয়, বেসরকারি প্রতিষ্ঠান মহাকাশ এবং গ্রহে জমি কেনা বেচা করতে পারে। তবে নাসা সেখানে গবেষণা চালালে বেসরকারি সংস্থাকে সেই জায়গা ছেড়ে দিতে হবে। সেক্ষেত্রে সম্পূর্ণভাবে জমি চলে যাবে সরকারি হাতে।“
এই দাবি একেবারেই ভুল। ২০১৫ সালে যুক্তরাষ্ট্র কমার্শিয়াল স্পেস লঞ্চ কমপিটিটিভ অ্যাক্ট অনুযায়ী, আমেরিকার কোনও বেসরকারি সংস্থা আউটার স্পেসে অনুসন্ধান চালাতে পারবে এবং মহাকাশের সম্পতি তাদের কাজের জন্য ব্যবহার করতে পারবে। কিন্তু, ১৯৬৭ সালের আউটার স্পেস ট্রিটির আইনের অনুযায়ী, কোনও সরকারি বা বেসরকারি সংস্থা মহাকাশের সম্পতির ওপর দখল দাবি করতে পারবে না। অর্থাৎ, এই নতুন অ্যাক্ট অনুযায়ী কোনও বেসরকারি সংস্থা তাদের অনুসন্ধানের জন্য আউটার স্পেসের সম্পতি ব্যবহার করতে পারবে কিন্তু তা দখল করতে পারবে না। এবং এই অ্যাক্টে জমি কেনা বেচার কথা কোথাও উল্লেখ করা নেই।
যুক্তরাষ্ট্রের ‘কমার্শিয়াল স্পেস লঞ্চ কমপিটিটিভ অ্যাক্ট’-টি পড়তে এখানে ক্লিক করুন।
গুগলে আরেকবার কিওয়ার্ড সার্চ করে দেখতে পাই, লুনার এম্বাসি ডট কম, মুনস্টেটস ডট কম, নামে আরও দুটি ভুয়ো ওয়েবসাইট সস্তায় জলের দামের চাঁদের জমি বিক্রি করছে।
নিষ্কর্ষঃ তথ্য যাচাই করে ফ্যাক্ট ক্রিসেন্ডো সিদ্ধান্তে এসেছে উপরোক্ত দাবি ভুয়ো। ইউএন আউটার স্পেশ অ্যাক্ট ট্রিটি অফ ১৯৬৭ অনুযায়ী, কোনও দেশ, সরকারি বা বেসরকারি সংস্থা চাঁদ, মঙ্গল এবং অন্য কোনও মহাকশের সম্পতির ওপর দখল দাবি করতে পারবে না। বাইমার্স নামের এই ওয়েবসাইটটি ভুয়ো। তাদের কাছে চাঁদ বা মঙ্গলের কোনও কপিরাইট নিয়ে। এবং দলিল হিসেবে যে সমস্ত কাগজ পাঠানো হচ্ছে সেটি কেবল কাগজ মাত্র। তার কোনও মুল্য নেই।